Monday, January 29, 2018

ভূতের সাক্ষাৎকার

ভূতের সাক্ষাৎকার
লেখনিতে : হিমু
আমার গল্পের নায়ক অনিকেত । তার বহুদিনের সাধ সে ইংলিশ ভুত দর্শন করবে । ভূত দর্শনের তেষ্টা মেটাতে তাই ছুটল ইংল্যান্ড। ব্রিটিশ রাজদরবার হতে মাইল পাঁচেক দুরের লজে উঠলো সে ।
তখন পুরো ইংল‍্যান্ড জুড়ে ভৌতিক পরিবেশ । সন্ধ্যা নামলো লজে । হ‍্যালোইন নাইট চলছে । লজের জানালা দিয়ে সে দেখছে বাহিরে হ‍্যালোজেন লাইট জ্বলছে । পাশের দোকানে রং বেরঙের মুখোশ পাওয়া যাচ্ছে । একে অন‍্যকে ভয় দিচ্ছে অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ করে ।
এবার হঠাৎ অনিকেত বাবু বিল্ডিং এর স্থাপত্য কলার দিকে নজর দিলেন । তার কাছে বিল্ডিং গুলোর নকশা কিছুটা খুফুর পিরামিডের মতো মনে হলো । আর নিজেকে মনে হলো মমির মতো । চারিদিকে শ্বশাণঘাটের নিরবতা । মাঝে মাঝে অদ্ভুত শব্দ । এই শব্দ শুনতে শুনতে তার ঘুম আসলো কেননা তিনি পুরো দিন ঘুরেছেন ইংল্যান্ডের পথে পথে । গেছেন ব্রিটিশ লাইব্রেরি ও ব্রিটিশ মিউজিয়াম । তার
পরও ছিল লঙ্গ জারনি ।
কিছুক্ষন ঘুমালেন তিনি । হঠাৎ লজের বারান্দায় শুনতে পেলেন জুতোর খট,খট আওয়াজ । সেটা সত্যি অন‍্যরকম ছিলো । তিনি ঘড়ি দেখলেন ও বুঝলেন রাতের শেষভাগ চলছে । তিনি অনুমান করলেন এটি বোধহয় কোন নারীর হাইহিলের শব্দ । নারী যদি হয় তবে এ লজের বারান্দায় কি করছে সে ? জানালার হালকা ছিদ্র দিয়ে তিনি দেখলেন,বাহিরে গুমোট অন্ধকার । পূর্বের মত চারিদিকে শ্বশাণঘাটের নিস্তব্ধতা । তার বুকের ধরফরানি বেড়ে গেলো,নাকের শীর্ষদেশে ঘাম জমলো যদিও সেখানে ভীষণ শীত ছিলো । হঠাৎ লজের দো বাইলের দরজায় ঠক ঠক শব্দ ।
অনিকেত কাঁপা গলায় বললো ক-কএ-কে ?
আগন্তুক : দরজা খুলুন (মেয়ে কন্ঠে) । পরে বলছি ।
অনিকেত :কি চাই ?
আগন্তুক : বললাম তো খুলুন । কোন ক্ষতি হবে না আপনার ।
অনিকেত উৎকণ্ঠা নিয়ে দরজা খুললো । খুলতেই অত্যন্ত সুন্দরী নারীর দর্শন পেলো সে । এমন সুন্দরী সে ইতোপূর্বে একটা ও দেখি নি । রাজকীয় গাউন পরা । সারা শরীর স্বর্নে মোড়া । গায়ে মৃগনাভির কুস্তুরির গন্ধ । সারা ঘর সে সৌরভে ভরে গেলো । স্বর্নের আলোয় অন্ধকার ঘর নিমিষেই আলোকিত হলো । সুন্দর চেহারার নারী অবয়ব দেখে ক্রমশ ভয় কমতে থাকলো অনিকেতের।
অনিকেত : কে আপনি ?
আগন্তুক : আমি ডাইনা । রাজা উইলিয়ামের মৃত পত্নী ।
অনিকেত : আমার কাছে কি দরকার ?
ডাইনা : দরকার নিশ্চয় আছে । সাক্ষাৎকার দিবো ।
অনিকেত : বেঁচে থাকতে তো অনেক ইংরেজ সাংবাদিক এর সাক্ষাৎকার উপেক্ষা করেছেন । হঠাৎ সাক্ষাৎ কারের জন‍্য এতো ব‍্যাকুল কেন ? ইংরেজ সাহেব রা কি সাক্ষাৎকার নিতে পারেন না ?
ডাইনা : বাঙালি বাবুরাই তো শুধু দেবদাস হতে পারে বলে হয়তো । ( উচ্চস্বরে হাসলেন তিনি )
অনিকেত : আমি ভূতকে ভয় দিতে দেখেছি । ভূতকে ভয়ঙ্কর হাসতে শুনেছি । তবে প্রনয় প্রস্তাব নিয়ে আসতে দেখি নি । আমার নিশ্চিতরূপে পাগল কুত্তার কামড় দেয়নি যে সুদর্শন ভূতের প্রেমে দেবদাস হবো ।
( একটু কাশি দিয়ে ) বেঁচে থাকতে তো কম খেলা খেলেন নি । বলেন তো ,ভূত হয়ে সত্যি চান কি এখন ?
ডাইনা : তুমি ভুল জেনেছো । তোমাদের পুরুষবাদী সমাজব‍্যবস্থায় আমরা ভীষণ ভাবে অবহেলিত । আমি তো চেয়েছি আমার স্বামীকে শিক্ষা দিতে । আমি চেয়েছি আমাকে ঘরে শো পিচ হিসেবে রেখে ক‍্যামেলিয়ার সাথে প্রেমের শাস্তি দিতে ।
অনিকেত : ম‍্যাডাম, আমি ব্রিটিশ লাইব্রেরীতে দেখছি তুমিও তোমার বাল‍্যবন্ধুর সাথে অন‍্যরকম সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলে । আসলে ইংরেজরা তোমরা সবাই বজ্রগুনন সম্পর্কে বিশ্বাসী ।
ডাইনা : মশাই,তুমি তো সাহিত্যের পাতা উল্টাও না । তোমাদের বাঙালিদের সমস‍্যা তোমরা সত‍্য স্বীকারে ভয় পাও ‌। তোমাদের সমাজে বর্বরতা নিহাত কম ছিলো
? চোখের বালিতে বালির দেবর বিহারী বাবুর সাথে বালির কি বজ্রগুনন সম্পর্ক ছিলো না ? অন‍্যদিকে বালির পতি কি বিনোদিনীর দিকে দৃষ্টি দেয় নি ? চারুলতায় কি চারু দেবরের দিকে অগ্রসর হয়নি ? ।"হাজার বছর ধরে" উপন্যাস যেটি তোমাদের বালকেরা বয়ঃসন্ধি কালে পাঠ‍্যসূচিতে থাকে তাতে কি টুনি মন্তুর অবৈধ প্রনয় প্রকাশিত হয়নি । "পদ্মা নদীর মাঝি" উপন্যাসে তো আরও খারাপ ভাবে অবৈধ প্রনয় ব‍্যক্ত হয়েছি । সেটিও তো পাঠ‍্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিলো ।
অনিকেত : হুম,বুঝলাম । তবে মানুষ পড়ে বলেই তো লেখকরা এমন বজ্রগুনন সম্পর্ক তুলে আনে । সাহিত্য বলতে এখন তো আমরা বুঝি রং চং মাখানো ত্রিকোন প্রেমের গল্প।
ডাইনা : মন্দ বলো নি । মানুষের মধ্যে বেড়ে উঠা পশুবৃত্তি গুলো সব সময় খারাপ জিনিসটা কে আকড়ে ধরতে বলে । আর সাহিত্য যখন এমন সুরসুড়ি দেয় তবেই বিপত্তি তখনই হয় ।
সাহিত্যের উচিত তবুও সত‍্যটা তুলে ধরা । তবে বয়ঃসন্ধিকালে এরূপ বাধ‍্যতামূলক রসাত্নক সাহিত্য হিতে বিপরীত ফল আনে
অনিকেত : আমি জানতে চায় তোমার সম্পর্কে । সাহিত্য সম্পর্কে নয় ।
ডাইনা : কি জানবে মৃত মানুষ থেকে ? তুমি সুন্দরী ও সুন্দরের উপমা ছিলে তবুও কেন উইলিয়াম তোমার মর্ম বুঝে নি ? একটু মানাই নিলেই তো হতে তুমি প্রায় এক-তৃতীয়াংশ রাষ্ট্রের রানী । এলিজাবেথ এর পরেই সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হতে পারতে ।
ডাইনা : প্রেম,প্রীতি, ভালোবাসা,ঘর-সংসার মানিয়ে নেওয়ার বস্তু না । এটি কাঁচের মত । ভাঙলে সে ক্ষত সারানোর না ।
অনিকেত : আমি শতশত বাঙালি কে দেখেছি ,হৃদয়ে ক্ষত নিয়ে সম্পর্ক কে বিস্তৃত করতে ঠিক অন্তিম মুহূর্ত প্রর্যন্ত । তবে তোমরা কেন পারো না ?
ডাইনা : অনিকেত,তোমাদের সমাজে নারীরা স্বনির্ভর নয় তাই তাদের সহনশীলতা একটু বেশি । আর তোমরা সমাজের ভয় পাও বেশি । যেটা আমরা পায় না ।
অনিকেত : তোমরা কি সুখ পাও তাতে ?
ডাইনা : সব সহ‍্য করে তোমরা কি সুখী ?
দুইজন মৃদু হাসলো । হঠাৎ প্রিস্নেস ডাইনা উধাও হয়ে গেলো । ব্রিটিশ লজের এক কোনে নিরবে বসে রইলো অনিকেত । ।


No comments:

Post a Comment